সফল হতে গেলে মনকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে স্থির রাখতে শেখা প্রয়োজন:-
যে কোনো কাজ করার জন্য মনকে স্থির রাখা খুব জরুরি। সহজ পরিস্থিতিতে আপনাকে খুশিতে, অথবা কঠিন পরিস্থিতিতে দুঃখে বিচলিত হলে চলবে না। শান্ত এবং স্থির মেজাজে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পৃথিবী তে যত প্রসিদ্ধ এবং বিখ্যাত লোক রয়েছেন অথবা ছিলেন, তা তিনি লেখক হন, শিল্পী হন, বা জননেতা, অথবা বিজ্ঞানী, সবাকার মধ্যে একটা সাধারণ মিল রয়েছে, সেটা হলো বিভিন্ন পরিস্থিতি তে মনকে শান্ত এবং অবিচল হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং কাজ করা। যাঁরা খুব বড় উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান বা বড় কিছু কাজ সম্পন্ন করতে চান তাঁদের জীবনকে পরিকল্পিত ভাবে তৈরি করতে হবে, এই নয় যে আপনা আপনি হবে। পরিকল্পিত ভাবে এবং পরিকল্পনা মাফিক উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে শান্ত ভাবে সেই পরিকল্পনা র নির্মাণ করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতেও স্থির থেকে যদি আপনি আপনার উদ্দেশ্য লেগে থাকার পদ্ধতি জেনে গেলেন, তাহলে জীবনে আপনার সাফল্য কেও আটকাতে পারবে না। বর্তমানে আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি যার মধ্যে আপনার মনকে বিচলিত করার বাহানা র অভাব নেই। মোবাইল এর মেসেজ, NOTIFICATIONS, বিভিন্ন টি ভি চ্যানেল, ইন্টারনেট সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়া সবসময় আপনার মনকে আকর্ষণ করে, মনকে বিচলিত করে। সেই জন্য মনকে শান্তিতে রাখা, এবং নিজের মনের আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করার খুব প্রয়োজন আছে।
ত্যাগ
এবং ক্রমাগত অভ্যাস এর মাধ্যমে আমরা নির্দিস্ট কাজে অবিচল থাকার অভ্যাস কে
প্রাপ্তি করতে পারি। প্রতিদিন ধ্যানাভ্যাস ছাড়াও প্রতিনিয়ত কিছু কার্যপ্রণালীর
মাধ্যমে 'নির্দিষ্ট
কাজে অবিচল থাকার অভ্যাস' কে প্রাপ্তি করতে পারা যায়।
1) মস্তিষ্কে
কি তথ্য ঢোকাবেন তা নিয়ন্ত্রণ করুন:-বর্তমান মাধ্যম আমাদের শুধু প্রতিক্রিয়াশীল
হতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মস্তিস্ক সবসময় বিনোদন এবং অভিনবত্ব চায়। আমাদের মস্তিস্ক মনে করে যে যতই তথ্য আমরা
বাইরে সংগ্রহ করে রাখতে পারবো ততই আমাদের সমাজে অস্তিত্ব রাখা সহজ হবে। সেই জন্যই
আমাদের মন আমাদের মূল্যবান সময় কে খবর, সোশ্যাল মিডিয়া, ওয়েব সিরিজ, টিভি অথবা অন্যের সাথে তর্ক বিতর্কে
সময় কাটাতে চায়। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ‘হারবাল সাইমন’ বলেন "বেশি তথ্যের ভান্ডার মনোযোগ
করার ক্ষমতা কে দুর্বল করে।" মন নির্দিষ্ট তথ্য সম্পন্ন হলে মনোযোগ বাড়ে।
অর্থাৎ আপনি যে উদ্দেশ্যে জীবন কে নিয়ে যেতে যেতে চান সেই উদ্দেশ্যে সহকারী তথ্য
বেশি জোগাড় করুন এবং যা আপনার উদ্যেশ্যের সহযোগী নয় তাদের সংগ্রহ করা কম করে দিন।
আর.. এক
এক তথ্য এক এক করে জানুন এবং নথি বদ্ধ করুন।
ইউটিউবে এ অনেক রকমের তথ্য পাওয়া যায়, সেই জন্যে দেখা যায় ধরুন আপনি কোনো নির্দিষ্ট গাড়ির মডেল
সম্বন্ধে ভিডিও দেখছেন। সেই ভিডিও তে যে
মডেল বিজ্ঞাপন করেছেন তাকে দেখতে পেলেন।
সেখান থেকে স্ক্রল করে গেলেন ভিডিওর
কমেন্ট বাক্স এ, সেখানে ওই বিজ্ঞাপন দেওয়া মডেল এর নাম
পেলেন। তার
পর খোঁজ করলেন ওই মডেল মহিলা সম্বন্ধে। তিনি একজন চলচিত্রের অভিনেত্রী। সেখান থেকে চলে গেলেন ওই মহিলা অভিনেত্রী
অভিনীত চলচিত্রের গানে। সেই গান দেখতে
দেখতে খোঁজ করলেন সেই গানটি কোন চলচিত্রের? খোঁজ করতে করতে চলে গেলেন সেই চলচিত্রে। এর পর আপনি ওই চালচিত্র দেখতে থাকলেন। অর্থাৎ আপনি বসেছিলেন গাড়ির মডেল খোঁজ করতে, আর সময় কেটে গেলো চলচিত্র দেখতে দেখতে।
এটা সম্ভব হলো কারণ ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের তথ্যের সংগ্রহ রয়েছে। এবং আপনার মন নির্দিষ্ট প্রয়োজনে স্থির
থাকতে পারলো না। এটাই আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে ও ঘটে। মস্তিষ্কে অনেক বেশি
অপ্রয়োজনীয় তথ্য ঢুকিয়ে দিলে মস্তিস্ক অযথা অপ্রয়োজনীয় তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে সময়
নষ্ট করে। তাই মস্তিষ্কে কি কি তথ্য ঢুকাবেন সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে, এবং দ্বিতীয়ত মনকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে স্থির রাখা অভ্যাস করতে হবে।
আমাদের মস্তিস্ক বেশি পরিশ্রম করতে চায় না, কম পরিশ্রম করে অথবা পরিশ্রম না করে যে
সব বিনোদক বিষয় পাওয়া যায়, সে সব বিষয় পছন্দ করে।
তাই
জীবনের লক্ষ্য বস্তু প্রাপ্তি করতে যে সব তথ্যাদি প্রয়োজন, তা খোঁজ করতে মন চায় না, বরং
মন গান, বাজনা, চলচিত্র, ঠাট্টা তামাশা ইত্যাদি সদ্য বিনোদনকারী
এবং তৎক্ষণাৎ বিনোদন দেওয়ার মতো বিষয় কে বেশি প্রাধান্য দেয়। অথচ যে বিষয়ে জানলে
তাঁর দীর্ঘমেয়াদি বড় সমস্যার সমাধান করবে সে বিষয়ে খোঁজ করতে সেই বিষয়ে কাজ করতে মন
চায় না,
কারণ ওতে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। এই সমস্যা থেকে উঠে আসতে হবে। আপনার বাস্তবে কি প্রয়োজন সেই প্রয়োজন
পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে এবং তার জন্য
দরকার পড়লে সাময়িক আনন্দ, বিনোদন কে ত্যাগ করতে হবে।
বর্তমানে
ইন্টারনেট এর কারণে সোশ্যাল মিডিয়া তে সময় বেশি কাটানো একটা সমস্যা হয়ে গেছে।
দৈনিক খবর, চটপটি
খবর, অন্যের সম্বন্ধে অপ্রয়োজনে জানার বেশি
আগ্রহ বেড়ে গেছে। অযথা অপ্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করার অভ্যাস বেড়ে যাচ্ছে, যা শুধু একটু সাময়িক সন্তুষ্টি ছাড়া কিছুই দেবে না।
লোক
শরীর কে ঠিক রাখার জন্যে জিম যান, খাদ্যতালিকা নিয়ন্ত্রণ করেন , তেমনি মন কে সঠিক নিয়ন্ত্রণ করতে তার
জন্য অভ্যাস করতে হবে এবং মনের যে খাদ্য তালিকা তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বর্তমান
এমন একটা সময় এসেছে যা অস্ত্রের থেকেও পর্দা বেশি ঘাতক হয়ে যাচ্ছে। টিভি র পর্দা, মোবাইল এর পর্দা, কম্পিউটার এর পর্দা ঘাতক হয়ে যাচ্ছে। তার সঠিক নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। মনকে সদ্য
বিনোদন কারী বিভিন্ন তথ্য, খবর, চলচিত্র ইত্যাদি জিনিস বার বার পর্দায় দেখিয়ে অন্যের মনোযোগ বিভ্রান্ত
করা হচ্ছে। আজকাল শিক্ষামূলক তথ্যের তুলনায় সদ্য বিনোদক তথ্য পর্দার সামনে বেশি
নিয়ে আসা হচ্ছে। এসব থেকে আপনাকে দূরে থাকতে হবে।
আজ মনের আবেগ কে আকর্ষণ করতে বিজ্ঞাপন এ সুন্দরী
সুন্দরী মহিলাদের পর্দায় নিয়ে আসা হয়, যা পুরুষ দের আকৃষ্ট করে, সেই বিজ্ঞাপন দেখতে বাধ্য করে। যদি আমরা আমাদের মন কে নিয়ন্ত্রণ করতে
শিখি, মানসিক স্থিরতা প্রাপ্তি করতে পারি, তাহলে নিজের লক্ষ্যে মনকে কেন্দ্রীভূত করতে পারবো। যেমন ভাবে আপনি
তাজা ফলটি খান, কিন্তু
পচে যাওয়া ফলটি ফেলে দেন। তেমনি ভালো প্রয়োজনীয় তথ্য গ্রহণ করুন, অপ্রয়োজনীয় তথ্য বর্জন করুন। এটা
কিছুদিন অভ্যাস করুন দেখবেন আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরে যাবেন।
সফল
ব্যক্তিরা অপ্রয়োজনীয় তথ্য মস্তিষ্কে ঢুকতে দেন না। এই জন্যই দেখবেন সফল ব্যক্তি রা সঙ্গে
একজন সহকারী রাখেন। সেই সহকারীর উদ্দেশ্যই হলো যাতে অপ্রয়োজনীয় তথ্য সেই সফল ব্যক্তিকে
বিচলিত না করে, বিরক্ত বা বিভ্রান্ত না করে এবং সফল ব্যক্তি নির্দ্বিধায় নিজের
উদ্দেশ্যে কাজ করে যেতে পারেন।
যত ভালো কাঁচামাল হয় উৎপাদিত বস্তুর গুণমান
ততটাই ভালো হয়। তেমনি মস্তিষ্কে যত উন্নতমানের তথ্য ঢুকাবেন মস্তিস্ক তত বেশি উন্নত মানের কাজ বাস্তবায়িত করতে পারবে।
২) সঠিকভাবে
বুঝতে শিখুন:- একটা
কথা আছে সবথেকে ভালো গাড়ি সেটাকে বলবো না যেটা দেখতে সুন্দর, সবথেকে ভালো গাড়ি সেটাকে বলবো যেটা
চালানো সহজ এবং যেটা কে রক্ষণাবেক্ষণ করতে কম
খরচ ও পরিশ্রম করতে হয়। যেটা
দামি কাপড় সেটা ভালো কাপড় নয়, ভালো কাপড় সেটা, যেটা পরে আপনি বেশি আরামদায়ক অনুভব
করেন।
আপনি
নিজের জীবনের প্রয়োজনীয়তাকে যদি সীমিত রাখেন, তাহলে আপনি মুক্ত হতে পারবেন। আপনাকে
কেও দুঃখী করতে পারবে না।
কখনো
কখনো দেখা যায় লোক খুব দামি জিনিস কিনে ফেলেন এবং পরে তার রক্ষনা বেক্ষন
করতে ঘাম ছুটে যায়। এমন দামি জিনিস কিনবেন না যা রক্ষনা বেক্ষন করতেই আপনাকে তার
সেবক হয়ে থাকতে হয়। সমঝদার ব্যক্তি নিজের জিনিষকে তাঁর কর্মী বানায়, নিজেই সেই জিনিসের কর্মী হয়ে যায়
না।
3)দৈনন্দিনের
কার্যতালিকা তৈরি করুন:- কখন ঘুম থেকে উঠবেন।
ঘুমথেকে উঠে কি করবেন। তারপর কি করবেন। এসব এর দৈনিক কার্য তালিকা তৈরি
করুন। যখন দৈনিক নির্দিষ্ট কাজ নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন করবেন, দেখবেন সেটা শরীর অভ্যাস করে নিয়েছে। দৈনিক ধ্যানাভ্যাস, যোগাভ্যাস, বা পড়ার অভ্যাস, নতুন কিছু শেখার অভ্যাস, নতুন জিনিসে পদক্ষেপ নিতে ঝুঁকি নেয়ার
অভ্যাস, এসব অভ্যাস রাখা দরকার। দেখবেন কখনো
এমন হয়েছে আপনি বাইক চালিয়ে অন্যদিনের মতোই কলেজ এ গেছেন। রাস্তায় আপনি অন্যমনস্ক
ছিলেন, আপনি কখন ব্রেক কষলেন, কখন গিয়ার্ বদল করলেন, কোনো মনে নেই। কিন্তু আপনি কলেজ এ পৌছে গেলেন। এসব তখনি সম্ভব হবে
যখন আপনার সেটা বারবার করে আপনার অভ্যাস হয়ে
গেছে। এমনি ভাবে কোনো জিনিস বারবার অভ্যাস করলে সেই কাজটা এতটাই আয়ত্ত হয়ে
যায় যে সেটা কখনো অন্যমনস্ক থাকলেও শরীর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে করে নেয়। সফল ব্যক্তি রা এটাই করেন। তাঁরা নিজের
কাজে এতটাই অভ্যস্ত হন যে পরে তাঁদের কাজ
সহজ, এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়। যার ফলে কোনো জিনিস প্রাপ্তিলাভ করা সহজ হয়ে যায়।
ধ্যানাভ্যাস
করেই যে শুধু স্থিরতা পাওয়া যায় এমন নয়, মন কে স্থির রাখার পদ্ধতি বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন রকম হতে পারে।
কিন্তু তার উদ্দেশ্য হলো আত্মিক বল প্রাপ্তি, মানসিক স্থিরতা প্রাপ্তি, মনের আবেগ এর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রাপ্তি
এবং মনের শান্তি প্রাপ্তি। এই ব্যস্ত একবিংশ শতাব্দী তে মানসিক স্থিরতা প্রাপ্তি
করা অতি আবশ্যক। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি কে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সেই সমস্যা কে কাটিয়ে উঠার জন্য
মানসিক স্থিরতা প্রাপ্তি খুব প্রয়োজন।
বাইরে
থেকে আসা কোন তথ্য কোনটা আপনি গ্রহণ করবেন এবং কোনটা গ্রহণ করবেন না, এই নিয়ন্ত্রণ এবং পরখ করার শক্তি যার
কাছে বেশি আছে, তিনিই
বেশি সফল হবেন। কারণ সেই বাইরে থেকে আসা তথ্য এবং তার প্রভাব মস্তিষ্কে ঢুকলে তা
সেই ব্যক্তির মানবিক চরিত্র গঠনে অংশগ্রহন করে, এবং সেই চরিত্রই তার নিয়তি কে নিয়ন্ত্রণ করে।
উপরের
সারাংশ "RYAN HOLIDAY" এর লেখা বই "STILLNESS IS THE KEY"
থেকে গৃহীত। বইটি তে আরো অনেক কিছু শেখার রয়েছে বইটি অবশ্যই পড়বেন।
0 Comments