শ্রীমদ্ভাগবত গীতা সার(Srimad Bhagwat Geeta Saar) :-

 শ্রীমদ্ভাগবত গীতা সার:-

গীতা হলো হিন্দুধর্মের আকর গ্রন্থ। এটি হিন্দুধর্মের সারাৎসার। একাগ্রচিত্তে শ্রদ্ধাভক্তি সহকারে গভীর মনোনিবেশ করে গীতা পাঠ প্রয়োজন। কল্যাণকামী মানুষের উচিত মোহ ত্যাগ করে অতিশয় শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে নিজ সন্তানদের অর্থ ও ভাবসহ গীতা অধ্যান করানো। এবং নিজেও এটির পঠন পাঠন মনন করে ভজনে তৎপর  হওয়া, কারণ এই অত্যন্ত দুর্লভ মনুষ্য দেহ লাভ করে জীবনের একমুহূর্তও দুঃখমূলক, ক্ষণভঙ্গুর ভোগে নষ্ট করা উচিত নয়।

উপদেশাবলী হলো গাভীসমূহ, সেই সকল গাভীর দোগ্ধা হলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং অমৃতময়ী গীতা হলো মহাদুগ্ধ। এবং সুধী ব্যক্তিগণ এই দুগ্ধের পান কর্তা।

যাঁর আকৃতি অত্যন্ত শান্ত। যিনি দেবগনেরও ঈশ্বর এবং সমস্ত জগতে আধার, আকাশের ন্যায় যিনি সর্বব্যাপী, নীল মেঘের ন্যায় যাঁর বর্ণ,  যোগীগণ যাঁকে ধ্যানের মাধ্যমে প্রাপ্ত হন,  যিনি সকল লোকের স্বামী এবং জন্মমৃত্যু মহাভয় বিনাশ কারী, সেই পরমাত্মা কে আমি প্রণাম করি।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন অস্ত্র নিক্ষেপের সময় উপস্থিত তখন কপিধ্বজ রথারূঢ় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ কে বললেন হে অচ্যুত.. আমার রথটিকে উভয় সেনার মধ্যে রাখুন।  এই যুদ্ধাভিলাষী বিপক্ষীয় যোদ্ধাদের একবার দেখি। শ্রীকৃষ্ণ রথ দুই পক্ষের সেনার মধ্যে ভীষ্ম দ্রোন এবং অন্যান্য রাজন্যবর্গের সামনে রথ নিয়ে এলে অর্জুন দেখতে পান পিতৃব্যগন, পিতামহগন, আচার্যগণ, মাতুলগন, পুত্রগণ ভাতৃগণ, পৌত্রগন,  মিত্রগন  সমেত যুদ্ধ করতে হবে।

অর্জুন বলেন হে কেশব আমি অশুভ লক্ষণ দেখছি। যুদ্ধে স্বজন দের হত্যা করে কোনো মঙ্গল দেখছি না।

কি গুরু, কি পিতৃব্য, পিতামহ, পুত্রাদির সঙ্গে যুদ্ধ করা তো পাপ ?  আমি আত্মীয়     স্বজনদের হত্যা করবো কিরূপে ?

শ্রীকৃষ্ণ বললেন অর্জুন.. কে নিজ, আর কে পর, তা কর্ম নির্ধারণ করে, জন্ম মৃত্যু নয়। এখানে শুধু দেখতে হবে ধৰ্ম এবং অধর্ম। যিনি ধৰ্ম এবং জনকল্যানে পক্ষপাতী তাকে সমর্থন করো এবং যিনি অধর্মের পক্ষপাতী  তিনি স্বজন বা পরজন হন না কেন, হত্যা করে পাপ নেই।

আর আত্মা তো অবিনাশী। তুমি কার হত্যা করবে?  পন্ডিতগণ মৃত বা জীবিত কারো জন্য শোক করেন না।

আত্মা অবিনশ্বর, অপ্রমেয় নিত্য রূপ। যিনি আত্মাকে হত্যাকারী মনে করেন অথবা যিনি এঁকে নিহত বলে মনে করেন তিনি আত্মার পরিচয় জানেন না। আত্মা কাউকে হত্যা করে না বা কারো দ্বারা হত হয় না। আত্মা জন্মরাহিত, নিত্য, সনাতন এবং পুরাতন। শরীর বালক, কুমার, যৌবন,  বার্ধক্য, এইসকল অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টি ও বিনষ্ট হয়, আত্মা নয়। আত্মা জন্মায় না বা মরেও না।

যেমন মানুষ পুরানো বস্ত্র পরিত্যাগ করে অন্য নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে,  তেমনি জীবাত্মা পুরানো শরীর গুলি ত্যাগ করে অন্য নতুন নতুন শরীর গ্রহণ করে।

আত্মাকে জল সিক্ত করতে পারেনা, অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, বা বায়ু শুস্ক করতে পারে না। আত্মা অচ্ছেদ্য,  অদাহ্যঃ, অক্লেদ্যঃ, অশেষ্য, নিত্য, সর্বব্যাপী, অচল, স্থির, এবং সনাতন। যে জন্মে, তার মৃত্যু নিশ্চিত  এবং মৃতের জন্মও নিশ্চিত। সমস্ত প্রাণী জন্মের পূর্বে অপ্রকট ছিল, মৃত্যুর পরেও অপ্রকট হবে, কেবল মধ্যবর্তী সময়ে প্রকটিত থাকে তাই এসম্বন্ধে শোক করা উচিত নয়। আর যদি তুমি তোমার কর্তব্যের দিকে দেখো তাহলে ধৰ্ম রক্ষা এবং প্রজা তথা জনগনের কল্যাণার্থে যুদ্ধ করে কোনো দোষ নেই।

তাই জয় পরাজয়, লাভক্ষতি, এবং সুখদুঃখকে সমান ভেবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।  এভাবে যুদ্ধ করলে তুমি পাপগ্রস্ত হবে না। তুমি কর্মযোগ বিষয়ে বোঝ, এই বুদ্ধি দ্বারা যুক্ত হলে তুমি অনায়াসে কর্ম বন্ধন থেকে মুক্তি পাবে। নিষ্কাম কর্ম যোগের বিফলতা হয় না এবং বিপরীত ফলরূপ দোষও হয় না। উপরন্তু এই নিষ্কাম কর্ম যোগের ধর্মের স্বল্প কার্যও জন্মে মৃত্যুরূপী মহা ভয় থেকে রক্ষা করে। তুমি ভোগ এবং তার আসক্তি থেকে বর্জিত হও।

যারা ভোগে আসক্ত চিত্ত, কর্র্মফল প্রশংসা কারী,  বেদবাক্য যাদের চিত্ত আকৃষ্ট, যাদের বুদ্ধিতে স্বর্গই পরম্পদ প্রাপ্য বস্তু, যারা বলে থাকেন স্বর্গ থেকে বড় আর কিছু নেই,  এইরূপ অবিবেক, দীন, অর্থাৎ যিনি আপাত মনোহর বাক্য বলেন, যা জন্মরূপ কর্মফল দান করে, এবং ভোগ ঐশর্যের জন্য নানারূপ ক্রিয়ার বর্ণনা করে তাদের পারামাত্মাতে নিস্চিয়াত্মিকা বুদ্ধি হতে পারে না।  

হে ধনঞ্জয় তুমি আসক্তি ত্যাগ করে, সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমভাবাপন্ন হয়ে থেকে যোগস্থ হয়ে কর্ম কারো। কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়অতএব কর্ম করো, কর্মফলের হেতু হয়ো না। কর্ম ফল নিয়ে চিন্তা করো না, সন্দেহ কারো না। কর্মে ফল কখনো বিফল যায় না। সেই জন্য কর্ম ত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়। সমত্ব বুদ্ধিযুক্ত পুরুষ ইহলোকে পাপ এবং পুন্য দুই থেকে মুক্ত হন। সমত্ব বুদ্ধিসম্পন্ন জ্ঞানীগণ কর্মজনিত ফল ত্যাগ করে জন্মরূপ বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে  নির্বিকার পরমপদ লাভ করেন। যখন তোমার বুদ্ধি মহারূপ সকল কর্দম সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে, তখন তুমি শ্রুত এবং শ্রোতব্য ইহলোক এবং পরলোক সম্পর্কীয় সমস্ত বিষয় ভোগে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হবে অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে তোমার নিত্য সংযোগ স্থাপিত হবে।

হে অর্জুন.. যখন যোগী মন হতে সমস্ত কামনা সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাগ করেন এবং আত্মাদ্বারা আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন তখন তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়।

যিনি দুঃখে অনুদিগ্ধচিত্ত, সুখে স্পৃহাহীন এবং আসক্তি, ভয় এবং ক্রোধরাহিত, যিনি শুভ এবং অশুভ বস্তুর প্রাপ্তিতে প্রসন্ন হন না বা দ্বেষ করেন না, তিনিই স্থীতপ্রজ্ঞ। কচ্ছপ যেমন আপন অঙ্গসমূহ সংহরণ করে নেয়,  সেই রূপ যিনি ইন্দ্রিয়াদির বিষয়বস্তু হতে ইন্দ্রিয়দের সর্ব প্রকারে সংহরণ করেন তিনিই স্থীতপ্রজ্ঞ। যোগীগণ ইন্দ্রীয়গুলিকে সংযত করে সমাহিত চিত্তে মাৎপরায়ণ হয়ে অবস্থান করেন। যাঁর ইন্দ্রীয় বশীভূত তাঁরই বুদ্ধি স্থির হয়।

বিষয় চিন্তা করতে করতে মানুষের ওই বিষয়ে আসক্তি জন্মায়। আসক্তি হতে কামনা উৎপন্ন হয়, এবং কামনা বাধা পড়লে ক্রোধের জন্মে হয়। ক্রোধ হতে মুড় ভাব উৎপন্ন হয়। মুড় ভাব হতে স্মৃতি ভ্রংশ হয়, স্মৃতিভ্রংশে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হলে পতন হয়। যার মন এবং ইন্দ্রিয় নিজের বশে নেই, তার নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি হয় না। সেই অযুক্ত ব্যক্তির অন্তঃকরণে ভগবত চিন্তা জাগে না.

জলের মধ্যে বিচরণশীল নৌকাকে যেমন বায়ু বিচলিত করে, তেমনি বিষয় ভোগে বিচরণকারী ইন্দ্রিয় সমূহের মধ্যে মন যেটিতে আকৃষ্ট হয় সেই ইন্দ্রিয়টিই অযুক্ত পুরুষের বুদ্ধি হরন করে।

যেমন বিভিন্ন নদীর জল পরিপূর্ণ অচল স্থির সমুদ্রে এসে তাকে বিচলিত না করেই বিলীন হয়ে যায়, তেমনি সমস্ত বিষয়ভোগে যাঁর কোনো বিকার উৎপন্ন না করে বিলীন হয়, তিনিই পরম শান্তি লাভ করেন। কিন্তু যিনি ভোগ্য পদার্থ কামনা করেন, তাঁর পক্ষে শান্তি লাভ অসম্ভব।

যিনি সমস্ত কামনা পরিত্যাগ করে মমত্ব শুন্য এবং অহং বর্জিত এবং নিস্পৃহ হয়ে বিচরণ করেন তিনিই পরম শান্তি লাভ করেন এবং তাঁরই ঈশ্বর লাভ হয়। এটা হলো ব্রহ্মপ্রাপ্ত পুরুষের স্থিতি। এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে তিনি আর কখনো মোহ গ্রস্ত হন না। অন্তিম সময়েও যিনি এই ব্রাম্হি স্থিতি লাভ করেন তিনি ব্রহ্মানন্দ লাভ করেন।

                                                                    ২য় অধ্যায়                                                                                          



অর্জুন বললেন হে জনার্দন যদি কর্ম অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ হয়, তবে কেশব আমাকে এই ঘোর কর্মে নিযুক্ত করছেন কেন?

ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বললেন হে অর্জুন..এই ইহলোকে দুপ্রকার সাধনা আছে জ্ঞান যোগ, আর কর্ম যোগ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে শুধু জ্ঞান যোগ দ্বারা অথবা শুধুই কর্মযোগ দ্বারা সিদ্ধি বা পরমগতি সম্ভব। জ্ঞান যোগ এবং কর্মযোগ উভয়ের পরিপূরক। জ্ঞান প্রাপ্তির মাধ্যমে ভালো-মন্দ উচিত-অনুচিত, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, কর্ম সম্বন্ধে জানা যায়। এবংযার ফলে যোগ্য কর্ম,  কল্যাণ কারী কর্ম চিনতে পারি এবং অযোগ্য,  অপ্রয়োজনীয়, অকল্যাণকারী কর্ম কে আলাদা করে তাকে পরিত্যাগ করতে পারি। জ্ঞান কর্মের শুদ্ধতার এবং অশুদ্ধতার পরিচয় করিয়ে দেয়।

এবং তার ফলেই সুকর্ম করে এবং পরম গতি লাভ করতে তথা ঈশ্বর সঙ্গে মিলিত হতে পারি। তাই জ্ঞান এবং কর্ম একে অপরের পরিপূরক। আবার শুধু জ্ঞান লাভ করেই  কোনো ফল নেই, যতক্ষন না সেই জ্ঞান কে কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা হয়। তাই জ্ঞান যোগ কর্ম যোগ ছাড়া সিদ্ধ হয় না, অথবা কর্মযোগ জ্ঞান যোগ ছাড়া শুদ্ধ হয় না। তাই হে অর্জুন জ্ঞান যোগ এর মাধ্যমে কর্ম যোগ কে শুদ্ধ করে সিদ্ধ কারো।

যজ্ঞের নিমিত্ত কর্ম ছাড়া অন্য কর্ম সংসার বন্ধনের কারণ হয়। তাই হে অর্জুন.. শুধু আসক্তি শুন্য হয়ে জ্ঞান যুক্ত কর্ম করো। কারণ আসক্তি রহিত হয়ে কর্ম করলে মানুষ পরমাত্মাকে লাভ করেন।

হে অর্জুন.. অন্তর্যামী পরমাত্মার নিবেদিত চিত্তে সমস্ত কর্ম অর্পণ করে আকাঙ্খা শুন্য,  মমতাবর্জিত এবং শোক রহিত হয়ে কর্ম করো।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন হে অর্জুন রজোগুণ থেকে উৎপন্ন কাম এবং ক্রোধ হলো অত্যন্ত পাপকারক।

ধুম্র দ্বারা অগ্নি, ময়লার দ্বারা দর্পন, এবং জরায়ুর দ্বারা গর্ভ যেমন আবৃত থাকে  তেমনি কাম দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে। এই কামই মন বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়াদি অবলম্বন করে জ্ঞান কে আচ্ছন্ন করে জীবাত্মা কে মোহিত করে। সেই জন্য হে অর্জুন তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে বশীভূত করে এই জ্ঞান বিজ্ঞান বিনাশকারী মহাপাপী কাম কে সবলে বিনাশ করো। স্থূল শরীর হতে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, মন হতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধি হাতে আত্মা শ্রেষ্ঠ। তাই শুভ বুদ্ধির দ্বারা মন কে বশ করে তুমি এই কাম রুপী দুর্জয় শত্রু কে বিনাশ করো।

                                                                        জ্ঞান যোগ

শ্রীকৃষ্ণ বললেন হে পরন্তপ অর্জুন আমার এবং তোমার বহুবার জন্ম হয়েছে, সেসব তুমি জানো না, আমি জানি। আমি জন্মরহিত, অবিনাশী এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হওয়া সত্বেও নিজ প্রকৃতিকে অধীন করে যোগমায়া দ্বারা প্রকটিত হই। যখন ধর্মের হানি এবং অধর্মের বৃদ্ধি হয় তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি অর্থাৎ সাকার রূপে নিজেকে জনসমক্ষে প্রকটিত হই। সাধুদের রক্ষার জন্য এবং পাপীদের বিনাশের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। যাদের আসক্তি এবং ক্রোধ সর্বত ভাবে নষ্ট হয়েছে, যারা আমার প্রেমে একাগ্র চিত্ত এবং আমাতে স্মরণাপন্ন, এরূপ বহুভক্তি, জ্ঞানরূপ তপস্যা দ্বারা পবিত্র হয়ে আমার স্বরূপে স্থিতি লাভ করেছেন।

হে অর্জুন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুভ্র এই বর্ন চতুষ্টয় গুন্ এবং কর্ম এর বিভাগ অনুযায়ী সৃষ্ট।

কর্মের ফলে আমার স্পৃহা নেই, তাই কোনো কর্ম আমাকে বদ্ধ করতে পারে না। এই রূপ যিনি আমাকে তত্বত জানেন - তিনিও কর্মের দ্বারা বদ্ধ হন না।

যিনি সকল ধৰ্ম এবং ফলের আসক্তি সর্বোতভাবে বর্জন পূর্বক, পরমাত্মাতে নিত্য তৃপ্ত, তিনি কর্মসমূহে বিশেষ ভাবে প্রবৃত্ত থাকলেও প্রকৃত পক্ষে কিছুই করেন না।

যিনি কোনো ইচ্ছা না রেখে যা পান তাতেই তুষ্ট, ঈর্ষা শুন্য, হর্ষ-শোকাদি দ্বন্দ হতে মুক্ত এবং সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমজ্ঞান সম্পূর্ণ তিনি শরীর ধারণের উপযোগী কর্ম করলেও তাতে বদ্ধ হন না। হে পরন্তপ অর্জুন.. দ্রব্যময় জ্ঞান হতে জ্ঞান জজ্ঞ শ্রেষ্ঠ , কারণ সমস্ত কর্ম জ্ঞানেই সমাপ্ত হয়। প্রজ্বলিত অগ্নি যেমন তার ইন্ধন কে ভস্মীভূত করে,  তেমনি জ্ঞান রূপী অগ্নিও সমস্ত কর্ম কে ভস্মীভূত করে। নিঃসন্দেহে এই জগতে জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছু নেই। যিনি জিতেন্দ্রিয় , সাধনা পরায়ন, শ্রদ্ধাবান,  তিনি জ্ঞানলাভ করে অচিরেই ভগবৎ প্রাপ্তিস্বরূপ পরমগতি লাভ করেন। বিবেকহীন,  শ্রদ্ধাহীন,  সংশয়কুল ব্যক্তি পরমার্থিক পদ হতে অবশ্যই ভ্ৰষ্ট হয়। এই রূপ সংশয়াত্মার ইহলোক ও নেই পরলোক ও নেই,  এবং সুখ ও নেই। যিনি কর্ম যোগের দ্বারা সমস্ত কর্ম পরমাত্মায় অর্পণ করেছেন এবং বিবেক দ্বারা সমস্ত সংশয় নাশ করেছেন এই রকম বশীভূত চিত্ত ব্যক্তি কে কর্ম কখনো বদ্ধ করতে পারে না। এবং হে অর্জুন তুমি হৃদয়স্থিত অজ্ঞান জাত সংশয় কে বিবেকজ্ঞানরূপ তরবারির সাহায্যে ছেদন করে সমত্ব যোগে স্থিত হও এবং যুদ্ধের জন্য উপস্থিত হও।

                                                                        কর্ম যোগ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন হে অর্জুন যিনি কারও প্রতি দ্বেষ করেন না,  কোনো কিছুর আকাঙ্খা করেন না, সেই নিষ্কাম সন্যাসীকে নিষ্কাম বলে জানবে। রাগ দ্বেষঃরূপ দ্বন্দরহিত পুরুষ অনায়াসে সংসার বন্ধন হতে মুক্ত হন। যার মন বশীভূত,  যিনি জিতেন্দ্রিয়, বিশুদ্ধচিত্ত, এবং সর্বপ্রাণীর আত্মারূপ পরমাত্মায় যার আত্মাস্বরূপ , এইরূপ নিষ্কাম কর্মযোগী কর্ম করলেও তাতে লিপ্ত হন না।

যিনি সমস্ত কর্ম পরমাত্মায় অর্পণ করেন, এবং আসক্তি ত্যাগ করে কর্ম করেন, তিনি জলের পদ্মপাত্রের ন্যায় পাপে লিপ্ত হন না। নিষ্কাম কর্মযোগী কর্মফল ত্যাগ করে অবিচল শান্তি লাভ করেন এবং সকাম ব্যক্তি কামনা বাসনার ফলে আসক্ত হয়ে আবদ্ধ হন। পরমেশ্বর মানুষের কর্তৃত্ব কর্ম বা কর্মফল প্রাপ্তি সৃষ্টি করেন না।কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে প্রবর্তিত হয়। ব্রহ্ম জ্ঞানী জ্ঞান বিদ্যাবিন্যায়যুক্ত ব্রাহ্মনে, গো, হস্তী   , কুকুর, তথা, চণ্ডালেও সমদর্শী হন।

যাঁদের মন সমভাবে অবস্থিত, তাঁরা জীবিত অবস্থাতেই সংসার জয় করেছেন, কারণ সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মা নির্দোষ এবং সম, তাই তাঁরা সেই পরমাত্মাতেই অবস্থান করেন। যাঁরা প্রিয়বস্তু লাভে হৃষ্ট হন না, এবং অপ্রিয়বস্তু প্রাপ্ত হলে উদ্বিঘ্ন হন না, স্থির বুদ্ধি,  সংশয়রাহিত এইরূপ ব্রহ্মাবেত্তা পুরুষ সচ্চিদানন্দঘন পরমব্রহ্ম পারমাত্মাতে  নিত্যস্থিত।

যিনি দেহত্যাগ করার পূর্বে কাম ক্রোধ হতে উৎপন্ন বেগ সহ্য করতে সক্ষম হন, তিনিই যোগী এবং সুখী। যিনি অনন্তরাত্মাতেই সুখযুক্ত আত্মারাম এবং আত্মাতেই জ্ঞানযুক্ত সেই সচ্চিদানন্দঘন পরমব্রহ্ম পরমাত্মার সঙ্গে একীভূত সাংখ্যযোগী ব্রহ্মানির্বান প্রাপ্ত হন। কামক্রোধ হতে মুক্ত সংযতচিত্ত ব্রহ্মদর্শী জ্ঞাণীপুরুষের সর্বদিক পরিপূর্ণ করে শান্ত পরব্রহ্মতেই স্থিত আছেন। বাহ্যবিষয় ভোগের চিন্তা না করে তাকে বাইরেই ত্যাগ করে, চোখের দৃষ্টি ভ্রূমধ্যে স্থাপন করে, নাসিকার মধ্যেবিচরণশীল প্রাণ ও আপান বায়ু কে সম করে এবং ইন্দ্রিয় মন ও বুদ্ধি কে সংযত করে ইচ্ছা ভয় ও ক্রোধ শূন্য হয়ে যে মোক্ষ পরায়ন মুনি সর্বদা বিরাজ করেন, তিনি সর্বদা মুক্তই থাকেন।


                                                                      ধ্যান যোগ।

   ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন যিনি কর্মফলের আশ্রয় না নিয়ে কর্তব্য করেন তিনিই সন্যাসী, তিনিই যোগী। হে অর্জুন যাকে সন্যাস বলা হয় তাকে তুমি যোগ বলে জানবে। কারণ সংকল্প ত্যাগ না করলে কেউ যোগী হতে পারে না। যখন সাধক ইন্দ্রিয়সমূহের ভোগে আসক্ত হন না এবং   কর্মেও আসক্ত হন না, তখন সেই সর্ব সংকল্প ত্যাগী পুরুষ কে যোগারূঢ় বলা হয়। যে আত্মার দ্বারা মন এবং ইন্দ্রিয়াদিসমূহ শরীর বশীভূত আছে, সেই আত্মা নিজেই নিজের বন্ধু এবং যে আত্মার দ্বারা মন এবং ইন্দ্রিয়াদি সহ শরীর বশীভূত হয় নি সেই আত্মা নিজেই নিজের শত্রু। শীত উষ্ণ, সুখ, দুঃখ এবং মান-অপমান এ যার চিত্ত সম্পূর্ণরূপে শান্ত, যার অন্তকরণ জ্ঞান বিজ্ঞানে পরিতৃপ্ত, যিনি বিকাররাহিত এবং জিতেন্দ্রিয়, যার দৃষ্টিতে মৃত্তিকা, প্রস্তর, এবং স্বর্ন সমতুল্য, তিনিই যোগযুক্ত।

সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ,  দ্বেষ, বন্ধু, ধর্মাত্মা এবং পাপীদের উপর যিনি সমভাব রাখেন  তিনিই প্রকৃত পক্ষে শ্রেষ্ঠ। মন এবং ইন্দ্রিয়ে যিনি সংযত দেহ, আকাঙ্খা শূন্য এবং সঞ্চয় বৃত্তি শূন্য, তিনি একাকী নির্জন স্থানে থেকে নিরন্তর চিত্ত কে পরমাত্মার ধ্যানে নিযুক্ত করবেন। পবিত্র সমতল স্থানে নিজের স্থির আসন স্থাপন করবেন, সেই আসনে বসে চিত্ত ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সংযত করে মনকে একাগ্র করে অন্তঃকরণে শুদ্ধির জন্য যোগ অভ্যাস করবেন।

মেরুদণ্ড, মস্তক ও গ্রীবাকে, সমান ও নিশ্চল ভাবে স্থির করে, নিজ নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি স্থাপন করে, অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে, ব্রহ্মচার্য ব্রতে স্থিত, ভয় রহিত, প্রশান্ত চিত্ত যোগী সতর্কতার সঙ্গে মনকে সংযত করে মদগত চিত্তে এবং মৎপরায়ণ হয়ে অবস্থান করবেন।

সংযত চিত্তে যোগী এইভাবে আত্মাকে নিরন্তর পরমেশ্বর স্বরূপ আমাতে সমাহিত করলে আমাতে স্থিত পারামানন্দের পরাকাষ্ঠা স্বরূপ শান্তি লাভ করেন। 

 সঙ্কল্পজাত সমস্ত কামনা নিঃশেষে ত্যাগ করে, মনের দ্বারা ইন্দ্রিয় সমূহকে সমস্ত বিষয় হতে নিবৃত করে, ধীরে ধীরে অভ্যাসের দ্বারা উপরতিতে স্থিত হবেন এবং ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মন কে পরমাত্মায় স্থাপন করে, পরমাত্মা ভিন্ন অন্যকিছুতেই চিন্তা করবেন না। চিত্ত যখন একান্তভাবে বশীভূত হয়ে পারামাত্মাতেই অবস্থান করে, তখন ভোগে সম্পূর্ণভাবে আকাঙ্খাশূন্য পুরুষ কে যোগযুক্ত বলা হয়।

  এই যোগ যাঁরা অত্যাধিক আহার করেন অথবা, একান্ত অনাহারী, যারা অতিশয় নিদ্রালু, অথবা অত্যন্ত জাগরণশীল, তাঁদের সিদ্ধ হয় না। দুঃখনাশক এই যোগ নিয়মিত আহার-বিহারকারী, কর্মে যথাযথ চেষ্টাকারী, নিয়মিত নিদ্রা ও জাগরণশীলদেরই সিদ্ধ হয়।

হে অর্জুন যিনি সর্বত্র সমদর্শী হয়ে সকলের সুখ ও দুঃখ কে নিজের সুখ ও দুঃখ বলে অনুভব করেন, আমার মতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।

মনকে নিঃসন্দেহে নিশ্চল এবং বশে রাখা দুস্কর, কিন্তু হে কুন্তীপুত্র অর্জুন অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা একে বশে রাখা যায়।

অর্জুন বললেন হে কৃষ্ণ যিনি যোগে শ্রদ্ধা রাখেন কিন্তু সংযত চিত্ত নন সেই জন্য অন্তিম সময়ে যার মন যোগ হতে বিচলিত হয়ে যায়, এইরূপ যোগী যোগসিদ্ধ না হয়ে পরমাত্মায় সাক্ষাৎকার না করে কি রকম গতি প্রাপ্ত হন? তিনি কি ভগবৎ প্রাপ্তির পথে বিভ্রান্ত এবং নিরাশ্রয় হয়ে ছিন্ন মেঘখণ্ডের ন্যায় উভয় পথ হতে ভ্ৰষ্টা হয়ে বিনাশপ্রাপ্ত হন ?

শ্রীকৃষ্ণ বললেন হে পার্থ সেই ব্যক্তির ইহলোক বা পরলোকে কোথাও বিনাশ নাই। কারণ কল্যাণ কারীর কখনো অধোগতি হয় না। যোগ ভ্ৰষ্ট ব্যক্তি পুণ্যাত্মাগণের প্রাপ্যলোক অর্থাৎ স্বর্গাদি উচ্চলোকে বহুকাল বাস করে পুনঃ সদাচার সম্পন্ন ধনীগৃহে জন্মগ্রহন করেন, অথবা যোগ ভ্ৰষ্ট   ব্যক্তি সেই সকল লোকাদিতে না গিয়ে জ্ঞানী বা যোগীর গৃহে জন্মগ্রহন করেনl  এইরূপ জন্ম জগতে অত্যন্ত দুর্লভ। সেই দেহে তিনি পূর্বজন্মের সুকৃতির ফলে মোক্ষপর বুদ্ধি লাভ করেন। এবং হে কুরুনন্দন তার প্রভাবে পুনরায় পরমাত্মাকে লাভের জন্য তিনি পূর্বাপেক্ষা তীব্রভাবে চেষ্টা করেন। তিনি যোগ ভ্রষ্ট হয়েও পূর্বজন্মের অভ্যাস বশে নিজের আবেশে ভগবানে আকৃষ্ট হন, তথা সমবুদ্ধির রূপ যোগে জিজ্ঞাসু ব্যক্তি ও বেদে বর্ণিত সকাম কর্মের ফালকে অতিক্রম করেন।

 কিন্তু যত্নপূর্বক অভ্যাস কারী যোগী বিগত বহুজন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কারের প্রভাবে এইজন্যেই পাপরহিত হয়ে যান এবং তৎকালেই পরমগতি লাভ করেন। সকল যোগীর মধ্যে যিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে মদগত চিত্তে নিরন্তর আমাকে ভাজন করেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।

                                                                  জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ

হে অর্জুন পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহংকার এই আট ভাগে বিভক্ত আপরা প্রকৃতি অর্থাৎ আমার জড় প্রকৃতি। এবং হে মহাবাহো এছাড়া অন্য প্রকৃতি, যাঁর দ্বারা এই সম্পূর্ণ জগৎ ধৃত আছে, তাঁকে আমার জীবরূপ পরা অর্থাৎ চেতন প্রবৃত্তি জানবে। আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তি এবং প্রলয়রূপ অর্থাৎ সমগ্র জগতের মূল কারণ। সূত্রে যেমন মুনিসমূহ গ্রথিত থাকে, সেইরূপ এজগৎ আমাতেই গ্রথিত আছে। আমি সূর্যের ও চন্দ্রের জ্যোতি, চারি বেদের ওঁ কার, আকাশের শব্দ, মনুষ্য মধ্যে পুরুষকার, আমিই পবিত্র গন্ধ, রস, রূপ, অগ্নিতেজ এবং সর্বভূতের জীবন তথা তপস্বীর তপ।

হে অর্জুন সকল ভুতের সনাতন বীজ আমি। আমিই বুদ্ধিবানের বুদ্ধি,  তেজস্বীর তেজ, এবং বলবানের বল। সত্ত্বগুণ, রজোগুণ, তমোগুণ  আমাতেই উৎপন্ন। গুনের কার্যরূপ সাত্বিক, রাজসিক, ও তামসিক, এই তিন প্রকার ভর দ্বারা এই সমস্ত জগতের প্রাণী সমূহ মোহিত আছে। তাই এই ত্রিগুণের অতীত অবিনাশী আমাকে তারা জানতে পারে না। 

অর্থার্থী, আর্ত, জিজ্ঞাসু, এবং জ্ঞানী এই চার প্রকার পুণ্যকর্মা ভক্তগণ আমাকে ভজন করেন। এদের মধ্যে নিত্যযুক্ত এবং একনিষ্ঠ সম্পন্ন জ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। কারণ জ্ঞানীর আমি অত্যন্ত প্রিয় এবং জ্ঞানীও আমার অতীব প্রিয়। বিভিন্ন ভোগাদির কামনায় যাদের জ্ঞান বশীভূত হয়েসেই নিয়ম পালন করে, অন্যান্য দেবতাদের ভজনা করেন অর্থাৎ উপাসনা করেন সেই ভক্তের শ্রদ্ধা আমি সেই দেবতাতেই দৃঢ় করে দিই। অর্থাৎ সেই দেবতার নিকট হতে সেই ব্যক্তি আমারই বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন। কিন্তু সেই অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ ফল বিনাশশীল। নিষ্কাম কর্মের আচরণ কারী যে সকল পুরুষের পাপ নষ্ট হয়েছে তাঁরা রাগ দ্বেষ জনিত দ্বন্ধ মোহ যুক্ত হয়ে দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে আমাকে ভজনা করেন।

যার অধিভূতঅধিদৈব, অধিযজ্ঞের সঙ্গে সবার আত্মারূপে আমাকে জানেন, সেই সকল সমাহিত চিত্ত ব্যক্তি, মৃত্যু কালেও আমাকে জানেন অর্থাৎ আমাকে প্রাপ্ত হন।


                                                                     অক্ষরব্রহ্মযোগ

অর্জুন বললেন হে পুরুষোত্তম ব্রহ্ম কি ? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি ? অধিভূত বা অধিদৈব কাকে বলে?

ভগবান কৃষ্ণ বললেন পরম অক্ষর হলো ব্রহ্ম, নিজরূপ অর্থাৎ জীবাত্মাই বলা হয় আধ্যাত্ম, এবং ভুতগণের ভাব উৎপন্ন কারী যে ত্যাগ তা হলো কর্ম। উৎপত্তি এবং বিনাশশীল সমস্ত বস্তুই অধিভূত হিরণ্যগর্ভ পুরুষই অধিদৈব। এবং দেহের আমিই অধিযজ্ঞ। মানুষ মৃত্যুকালে যে যে ভাব স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করেন, তিনি সেই ভাবই প্রাপ্ত হন। অতএব হে অর্জুন তুমি আমাকে স্মরণ কারো এবং কর্ম কারো।

পরমেশ্বরের ধ্যানে অভ্যাসরূপ যোগে যুক্ত হয়ে অনন্যগামী চিত্তে নিরন্তর চিন্তামগ্ন পুরুষ জ্যোতির্ময় পরম দিব্য পুরুষ কে অর্থাৎ পরমেশ্বর কে লাভ করেন।

যিনি সর্বজ্ঞ সনাতন, বিস্বনিয়ন্তা এবং সূক্ষাতিসূক্ষ, সকলের ধারণ পোষণ কারী, অচিন্ত্য স্বরূপ, সূর্যের ন্যায় স্বপ্রকাশ এবং বিদ্যার অতীত, শুদ্ধ সচ্চিদানন্দ ঘন পরমেশ্বর কে স্মরণ করেন।

সেই ভক্তিমান ব্যক্তি অন্তিম কালে যোগ বলের দ্বারা ভ্রূযুগলের মধ্যে প্রাণকে ধারণ পূর্বক একাগ্র মনে স্মরণ করে সেই দিব্য পরম পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হন।

সমস্ত ইন্দ্রিয় দ্বার সংযত করে এবং মনকে হৃদয় নিরুদ্ধ করে, প্রাণকে মস্তকে স্থাপন করে, পরমাত্মা সম্বন্ধী যোগস্থিত হয়ে, যিনি ওঁ এই একাক্ষর ব্রহ্মা উচ্চারণ করতে করতে দেহত্যাগ করেন তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন। নিত্য  নিরন্তর স্মরণশীল যোগীর নিকট আমি সহজলভ্য। হে অর্জুন মুক্ত মহাত্মাগণ আমাকে লাভ করে আর দুঃখ আলয়ে, খানভঙ্গুর, সংসারে,পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন না। আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না। কারণ আমি কালাতীত এবং এই সমস্ত লোককালের অধীন হওয়ায় আমি অনিত্য। তাই তুমিও সর্বদা সমবুদ্ধি সম্পন্ন যোগে যুক্ত হও অর্থাৎ আমাকে প্রাপ্তির জন্য নিরন্তর সাধনাপরায়ণ হও। 

                                                                    রাজবিদ্যাগুহ যোগ

হে অর্জুন নিরাকার পারামাত্মারূপী আমার দ্বারা এই সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত আছে। এবং সমস্ত ভুত আমাতেই অবস্থিত, কিন্তু আমি সেগুলিতে নেই।

কল্পের শেষে সমস্ত ভুত আমার প্রকৃতিতে বিলীন হয়, এবং কল্পের আরম্ভে পুনরায় আমি তাদের সৃষ্টি করি। আমার অধ্যক্ষতার দ্বারা প্রকৃতি এই চরাচর সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করে। এই জন্য জগৎ রূপে চক্র আবর্তিত হয়। আমি সর্বভূতের সনাতন, কারন আমি অবিনাশী।

জ্ঞানযোগী জ্ঞানরূপ যজ্ঞের দ্বারা নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মাকে উপাসনা করেন।  আমিই সমস্ত জগতের ধারণ কারী, কর্মের ফল প্রদান কারী আমিই পবিত্র ওমকার।

শুদ্ধচিত্ত হয়ে যারা অন্য দেবতার পূজা করেন, তাঁরাও প্রকৃতপক্ষে আমাকেই পূজা করেন।

হে অর্জুন তুমি যা কর্ম কারো, যা আহার কারো, যা হোম কারো, যা দান কারো, এবং যে তপস্যাই কারো, তা সবই আমাকে অর্পণ করা হয়। আমাতে সমস্ত অর্পণ দ্বারা সন্যাস যোগে যুক্ত হয়ে তুমি শুভাশুভ ফলরূপ কর্ম বন্ধন হতে মুক্ত হবে এবং আমাকে প্রাপ্তি হবে। তুমি নিশ্চিত জেনো যে আমার ভক্ত কখনো বিনষ্ট হয় না।

                                                                       বিভূতিযোগ

হে অর্জুন যিনি আমাকে জন্মরহিত, অনাদি এবং সর্বলোকের মহেশ্বর বলে তাত্বতা জানেন, তিনি মনুষ্য মধ্যে মোহ শুন্য হয়ে সর্বপাপ হতে মুক্ত হন।

সর্বদা আমার ধ্যানে আসক্ত এবং প্রেমপূর্বক ভজনশীল ভক্তদের আমি তত্বজ্ঞানরূপ যোগ প্রদান করে তাদের অজ্ঞান জনিত অন্ধকারকে নাশ করি। আমি সর্বব্যাপী সনাতন, জন্মরাহিত, দিব্যপুরুষ এবং আদিদেব। সর্বভূতের হৃদয়স্থিত সকলের আত্মা আমিই এবং সর্বভূতের আদি মধ্য এবং অন্ত ও আমিই। সকল ভুতের উৎপত্তির কারণ ও আমি কারণ স্থাবর বা জঙ্গম এমন কোনো প্রাণী নেই যা আমাকে ছাড়া সত্বা বান হতে পারে। হে অর্জুন একনিষ্ঠ ভক্তি দ্বারাই আমাকে জানতে এবং স্বরূপ প্রত্যক্ষ করতে এবং আমাতে প্ৰৱেশ করে মোক্ষলাভ করতে সমর্থ হয়, অন্য উপায়ে নয়। যে ব্যক্তিগণ আমারই সমস্ত কর্ম করেন, আমার পরায়ন হন,আসক্তিশুন্য হন, এবং সমস্ত প্রাণীতে বৈরীভাব রহিত হন, সেই অনন্য ভক্তি যুক্ত পুরুষ আমাকেই প্রাপ্ত হন।

                                                                      ভক্তিযোগ

হে অর্জুন আমাতে মনোনিবেশ পূর্বক নিত্য নিরন্তর ভজন ধ্যানে নিযুক্ত থেকে যে ভক্ত গন অতি শ্রদ্ধাসহকারে সগুণ পরমেশ্বর রূপী আমাকে উপাসনা করেন, তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন। আবার ইন্দ্রিয়সমূহ কে সংযত করে, মনবুদ্ধির অগম্য সর্বব্যাপী অব্যক্তস্বরূপ অবিনাশী সাচ্চিদান্দঘন   ব্রহ্ম এর নিরন্তর একাত্মভাবে ধ্যানযুক্ত হয়ে উপাসনা করেন এবং সকল প্রাণীর হিতে রত এবং সর্বত্র সমান ভাবাপন্ন, তাঁরাও আমাকেই প্রাপ্ত হন।

যিনি সর্বভূতের দ্বেষ হীন, স্বার্থপরতা রহিত, সর্বভূতে প্রেমভাবাপন্ন, হেতুরহিতভাবে দয়ালু, মামাত্ববুদ্ধিশূণ্য, নিরহঙ্কার, সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সদা সন্তুষ্ট, সদা সমাহিতচিত্ত, সদা সংযত স্বভাব, সদা আমার প্রতি দৃঢ় নিশ্চয় যুক্ত, পক্ষপাতশূন্য, ভয়মুক্ত, যার মন বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।                                                     

                                                           ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞা বিভাগযোগ

হে অর্জুন এই দেহে অবস্থিত যে আত্মা তিনিই প্রকৃতপক্ষে পরমাত্মা। তিনিই সাক্ষী হওয়ায় উপদ্রষ্টা। যথার্থ সম্মতি দেওয়া অনুমন্তা, সকলের ধারক ও পোষাক হওয়ায় ভর্তা, জীবরূপে ভোক্তা, ব্রহ্মাদি সকলের স্বামী হওয়ায় মহেশ্বর, এবং শুদ্ধ সচ্চিদানন্দ হওয়ায় পরমাত্মা বলে জানো। আত্মা দেহের সর্বত্র অবস্থান করলেও নির্গুণ হওয়ায় দৈহিক গুণাদিতে কখনো লিপ্ত হন না। আমার স্বরূপ প্রাপ্ত পুরুষ সৃষ্টিকালে জন্মগ্রহন করেন না, এবং প্রলয়কালে ব্যথিত হন না অর্থাৎ জন্মমৃত্যু অতিক্রম করেন।

হে অর্জুন সত্ব, রজ ও তম প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন এই তিনটি গুন্ অবিনাশী জীবাত্মাকে শরীরে আবদ্ধ করে। এই তিনটি গুনের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল হওয়ায় প্রকাশশীল এবং বিকার রহিত। রজোগুণ হলো রাগাত্মক, এটি কামনা এবং আসক্তি থেকে উৎপন্ন হয়। এ জীবাত্মাকে কর্ম এবং ফলের নিমিত্ত আসক্ত করে। আর রজোগুণ উৎপন্ন হয় অজ্ঞান থেকে,  এ জীবাত্মাকে প্রমাদ, আলস্য  এবং নিদ্রার দ্বারা বন্ধন করে।

রাজো গুন্ বৃদ্ধি হলে লোভ, প্রবৃত্তি, স্বার্থবুদ্ধিতে,সকাম কর্মে প্রবৃত্তি, অশান্তি এবং বিষয় ভোগের লালসা উৎপন্ন হয়। তমোগুণ বৃদ্ধি হলে অন্তঃকরণে এবং ইন্দ্রিয়ে, অপ্রকাশ, কর্তব্য কর্মে অপ্রবৃত্তি প্রমাদ বা ব্যর্থ চেষ্টা, নিদ্রাদি অন্তঃকরণে মোহিনীবৃত্তি এই সব উৎপন্ন হয়।

সত্ত্বগুণের বৃদ্ধিকালে মানুষ দেহত্যাগ করলে উত্তম উপাসকগণের সুখময় ব্রহ্মালোকাদিতে গমন করেন।

সাত্বিক কর্মের ফল নির্মল সুখ, রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ এবং তামসিক কর্মের ফল অজ্ঞান। 

যিনি নিরন্তর আত্মভাবে স্থিত সুখদুঃখে সমস্থিত মাটি পাথর ও স্বর্ণে সমভাববিশিষ্ট, প্রিয় ও অপ্রিয় সমজ্ঞানযুক্ত, নিন্দা ও স্তুতিতে সমভাবাপন্ন, সেই ধীর ব্যক্তি গুণাতীত।

অতঃপর সর্বোতভাবে সেই পরমপদ রূপ পরমেশ্বর এর অন্বেষণ করা উচিত, এবং যে পরমেশ্বর হতে এই অনাদি সংসার প্রকৃতির বিস্তার হয়েছে, আমি সেই আদিপুরুষের সামনে গত হই, এইরূপ দৃঢ় নিশ্চয় হয়ে সেই পরমেশ্বর এর মনন ও নিত্যধ্যান করা উচিত। যাঁদের মন এবং মোহ দূর হয়েছে, যারা আসক্তি জয় করেছেন,যাঁদের পরমাত্মার স্বরূপে নিত্যস্থিতি এবং যাঁদের কামনা সম্পূর্ণভাবে নিবৃত্ত হয়েছে, সেই সকল সুখ দুঃখ দ্বন্ধমুক্ত জ্ঞানী ব্যক্তি অবিনাশী পরমপদ লাভ করেন।

       হে অর্জুন যে জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বহুবাধাবিভক্ত সর্বভূতে অবস্থিত এক অবিনাশী পরমাত্মা তত্বকে অবিভক্তরূপে দেখে, সেই জ্ঞান কে তুমি সাত্বিক জ্ঞান জানবে। কিন্তু যে জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বহুধাবিভক্ত সমস্ত ভুতে অবস্থিত নানা ভাবকে পৃথক পৃথক রূপে দেখে, সেই জ্ঞানকে রাজস জ্ঞান বলে জানবে।

যে জ্ঞানের দ্বারা কোনো একটি কার্যরূপ দেহেই সম্পূর্ণের মতো আসক্তি জন্মায়, সেই যুক্তিবিহীর অযথার্থ এবং তুচ্ছ জ্ঞান কে তামশ জ্ঞান জানবে।

ফলে অনাসক্ত,  কর্তৃত্ব অভিমান রহিত,  ধৈর্যশীল, উদ্যম যুক্ত এবং ক্রিয়ামান কর্মের সিদ্ধিতে হর্ষাহীন ও অসিদ্ধিতে বিষাদরাহিত কর্তাকে সাত্বিক কর্তা বলা হয়। বাসনাকুলচিত্ত কর্মফলাকাঙ্খী পরদ্রব্যে লোভী,  পরপীড়ক, বাহ্য অন্তর শৌচহীন, ইষ্টপ্রাপ্তিতে হর্ষযুক্ত এবং এবং অনিষ্ট প্রাপ্তিতে বিষাদযুক্ত-এইরূপ কর্তাকে রাজস্ কর্তা বলা হয়।

বিক্ষিপ্ত চিত্ত অত্যন্ত অসংস্কৃত বুদ্ধি, ধূর্ত, পরাবৃত্তি নাশকসদাবিষণ্ন, অলস ও দীর্ঘসূত্রী কর্তাকে তামস কর্তা বলা হয়।

 

 হে অর্জুন.. বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত, সাত্বিক, মিতভোজী, শব্দাদি বিষয়সমূহ ত্যাগ করে একান্ত এবং শুদ্ধস্থান বসবাস কারী, সাত্বিক ধৃতির দ্বারা অন্তকরণ ও ইন্দ্রিয় সংযম করে, কায়মানো বাক্যে সংযমী, রাগদ্বেষ সর্বোতভাবে বর্জন পূর্বক দৃঢ় বৈরাগ্য অবলম্বন করে, তথা অহংকার, বল,  দর্প , ক্রোধ এবং পরিগ্রহ ত্যাগ করে, নিরন্তর ধ্যানযোগে নিয়ত মমত্বশুণ্য, প্রশান্তচিত্ত ব্যক্তি সাচ্চিদানন্দঘন ব্রহ্মহ তে অভিন্নরূপে অবস্থান করতে সমর্থ হন।

                                                 -----------------------------------------------         

 উপরের এই তথ্য ভালো লাগলে এবং উপকারী মনে হলে অবশ্যই Like  এবং Share করুন।

 


আরো পড়ুন:Finish what you Start. ,  Five ghosts of fear,   Rules for Success

                      How Success Rule works? ,  7 Habits of Highly Effective People ,

                      Ratan Tata, Mukesh Ambani, Azim Premji, Gandhiji, Mandella, Kalam's Quotes

                      Motivational And Inspirational Quotes For Success , THE 10X RULE

                      Dan Lok's Advice  For Success ,   14 Risks you must take for Success

                      চিন্তন করুন এবং সফল হন ,  কেন করবেন ? সেটা জেনে তবেই কাজটি করুন , 

                      জীবনে কম্পাউন্ড ইফেক্ট এর প্রভাব , বাধার মধ্যে দিয়ে পেরিয়েই সফলতা আসে ,

                      অহংকার হলো চরম শত্রু , আত্মজ্ঞান কি  ,

                     আকর্ষণ সূত্র , সফল না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা ছাড়বেন না , সফল ব্যক্তিদের 11 টি গুন্ , 

                সফলতার ১০ টি সূত্র , ১০ গুন্ সফল হবেন কিভাবে ?জীবনের আশ্চর্জজনক রহস্য ,

                ছোট ছোট অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে বড় লক্ষ্য প্রাপ্তি , 

                মহান ব্যক্তিদের সাতটি অভ্যাস , How to "IKIGAI"?

                ব্যবসার জন্য মুদ্রা লোন PMMY  Loan ,  Inner Engineering by Sadguru Jaggi Vasudev

                       আকর্ষণের সূত্র  , ডোনাল্ড ট্রাম্প এর সফলতার ১৫ টি সূত্র , 


For Motivational Articles In English visit..... www.badisafalta.com

   

 


           

Post a Comment

1 Comments